আজ আবিদের মন ভাল নেই। কারন ঘুম
থেকে উঠতে দেরি হয়েছে।সূর্য রোদ
ছড়াতে শুরু করেছে তখন। কোনো রকমে
ফজরের কাজা নামাজ পড়েই সিএনজিতে
চড়ে অফিসে যাচ্ছে। আজ কোরআন শরিফ
পড়া হয়নি। অন্যদিন দুই আয়াত হলেও পড়ে।
কোরআন শরিফটা অনেক পুরনো। আবিদের
বাবা পড়তেন এই কোরআন।বাবা বেঁচে
নেই। প্রায় পাঁচ বছর হয়েছে তিনি
কোরআন শরিফ পড়েন না। এখন আবিদ পড়ে।
প্রতিদিন সকালবেলা। ছুটির দিন অনেক
বেলা পর্যন্ত পড়ে। পড়ে যেন স্বাদ
মেটে না। বাবার একটা কথা খুব মনে
পড়ছে।বাবা বলতেন,কোরআন এক অসাধারণ
সাহিত্য। এমন সাহিত্য আর কখনো জন্মাবে
না। ঠিক সাহিত্য বললে ভুল হবে কিনা
জানি না। তবে আমার কাছে এটাই মনে
হয়। এটা সাধারন সাহিত্য না। আল্লাহর
তৈরি সাহিত্য। প্রতিটি শব্দের ভেতরে
নিগূঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে।
এই কথাটা আবিদের বাবা তাকে বারবার
বলতেন। কিন্তু বাবা বেঁচে থাকতে সে
একথা বোঝেনি। এখন বোঝে। পুরনো
কোরান শরিফ টা আজও বদলানো হয়নি।
পুরনো কোনো জিনিস যদি প্রিয়জনকে
মনে করিয়ে দেয় তাহলে পুরনো সেই
জিনিস যেন মহামূল্যবান হয়ে ওঠে। কি
দরকার বদলানোর! কোরান শরিফটা পড়ার
সময় সে নিজের কণ্ঠস্বরকে চিনতে পারে
না। মনে হয় সে না, বাবাই পড়ছে। কি মধুর
কণ্ঠ ছিল বাবার। তখন আবিদের অডিও
রেকর্ডার মোবাইল ছিল না। থাকলে
রেকর্ড করে রাখতো। সারা জীবন শোনা
যেতো সেই সুললিত কণ্ঠ। বিজ্ঞান
জীবনকে সহজ করেছে। কতোই না
আরামদায়ক জীবন। জীবন সহজ হওয়ার
পাশাপাশি কঠিনও হয়েছে। সহজসরল
জীবনকে বিজ্ঞানে জটিল জালে
জড়িয়ে নিয়েছে সবাই। সবচেয়ে অদ্ভুত
বিষয় হচ্ছে নিজের সৃষ্টিকর্তার কথা ভুলে
গিয়েছে অধিকাংশ লোক। এই কর্মব্যস্ত
শহর দেখে আবিদ তা বুঝতে পারে। এই শহর
কখনো থামে না। রাত যায়, দিন যায়। তবুও
থামে না। আজানের সময়ও না। শহরের
অজস্র মানুষ আর গাড়ির কলহে আজানের
ধ্বনি যেন অস্পষ্ট মনে হয়। তবুও এই অস্পষ্ট
ধ্বনির মহত্ত্ব যারা বোঝে, তারা
নামাজে যায়। কেউ আল্লাহর ভয়ে
নামাজ পড়ে। কেউকেউ নামাজ না পড়লে
শান্তি পায় না, তাই পড়ে। কেউ বুঝে
পড়ে। আবার কেউ না বুঝে পড়ে।
আবিদের বাবা বলতেন, কাওকে ছোট
ভাববি না আবিদ। যারা নামাজ পড়ে না
তাদেরকেও না। যারা আল্লাহ ও আল্লাহর
রাসূল(স)-কে চেনে না,তারাই নামাজ
পড়ে না। তুই ওদেরকে ঘৃণা করবি না। যদি
পারিস তাহলে ওদেরকে বোঝাবি
আল্লাহর মহত্ত্ব, রাসূল(স) এর মহত্ত্ব। দেখবি
একদিন ওরাই আল্লাহকে তোর থেকেও
বেশি স্মরণ করবে।
.
হটাৎ সিএনজি টা জ্যামে আটকে গেল।
মোবাইলে সময় দেখল আবিদ। আফিস শুরু
হতে এখনো ঘণ্টা খানেক বাকি । কিন্তু এই
শহরের জ্যাম সময় গুলোকে খুব তাড়াতাড়ি
নষ্ট করে। জ্যামে আটকে পড়লে আবিদ
মস্তিষ্ককে অলস রাখে না,ভাবে। ভাবে
মৃত বাবার কথা,অসুস্থ মায়ের কথা। চোখ
বুঝলে মায়ের চেহারা স্পষ্ট ভাবে
ভেসে ওঠে। কিন্তু বাবার চেহারা সবসময়
স্পষ্ট হয়না। মাঝেমাঝে স্পষ্ট হয়। আবার
মাঝেমাঝে একেবারেই কল্পনায় আনতে
পারে না। এমন কেনো হয় জানেনা
আবিদ। আজ নিজেকে খুব একা লাগছে।
নিস্ব লাগছে। 'স্যার কয়ডা ট্যাকা দেন'
কথা শুনে আবিদ বাস্তবে ফিরে আসে।
কালো রঙের একটা ছেলে। কিন্তু চোখ
দুটি খুবই সুন্দর। আল্লাহ মানুষকে কোনো না
কোনো দিক থেকে সুন্দর করে। তিনি
তো করুণাময়, রাহমানির রহিম। স্যার দুইডা
ট্যাকা দেন, বলল সুন্দর চোখের ছেলেটা।
আবিদ জানে এই ছেলেগুলো বস্তিতে
থাকে।তাই মানিব্যগ থেকে টাকা বের
করতে করতে জিজ্ঞাসা করল, বস্তিতে
কে কে আছে তোমার? ছেলেটা
বলল,কেউ নেই। অবাক হলো আবিদ। বলল,
বাবা-মা নেই? ছেলেটা স্বাভাবিক
ভঙ্গিতে বলল,না। তারপর চলে গেল।
সামনের সিএনজিতে গিয়ে টাকা
চাচ্ছে। কেউ দিচ্ছে, কেউ দিচ্ছে না।
আবিদের এখনো মন খারাপ। নিজের জন্য
না। সুন্দর চোখের ছেলেটার জন্য।
কিছুকিছু দিন যেন মন খারাপের জন্য শুরু হয়।
বাবার আরো একটা কথা খুব মনে পড়ছে।
বাবা বলত,যখন খাদ্যের অভাব বোধ করবি
তখন ওদের কথা ভাববি,যারা পঁচা খাবার
খায়। যখন পোশাকের অভাব বোধ করবি
তখন ছেঁড়া কাপড়ের মানুষ গুলোর কথা
ভাববি।দেখবি নিজেকে নিয়ে মন
খারাপ হবে না। ওদের কষ্টের কাছে
তোর কষ্ট ছোট মনে হবে।
বাবা কখনো বলেননি,আমি যখন মারা যাব।
তখন মন খারাপ করবি না। আর যদি খুব কষ্ট হয়
তাহলে ওদের কথা ভাববি,যাদের জন্মের
পর থেকে বাবা-মা নেই।তাহলে দেখবি
আর আমার জন্য কষ্ট হবে না। বাবা একথা
বলেননি কখনো। কিন্তু আবিদের মনে
হচ্ছে একথাও তার বাবার। জ্ঞানী
মানুষেরা সব কথা সরাসরি বলেন না। কিছু
কথা কথার মাঝে রেখে দেন।
.
সিএনজি চলতে শুরু করেছে। মৃদু ঝাঁকুনিতে
মাথার ভেতর সুন্দর চোখের ছেলেটাকে
নিয়ে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
ছেলেটা কি জন্মের পর থেকে কোনো
দিন মা-বাবাকে দেখেনি।নাকি বাবা-
মা যার যার মত আবার বিয়ে করেছে।
বস্তির বাবা গুলো সংসার,সন্তান ছেড়ে
আবার বিয়ে করে। কিন্তু মা গুলো করে
না। করলেও সন্তানকে সাথে নেয় যায়।
তাহলে সুন্দর চোখের ছেলেটার মাবাবা
কেউ নেই কেনো? নাকি মা মারা
গেছে? আর ভাবতে পারছে না আবিদ।
বেশি ভাবলে তার মাথা ব্যথা করে। তাই
ভুলে যেতে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে
না। মনের ভেতর আরো শক্ত ভাবে শিকড়
গেড়ে বসছে ছেলেটা। ছেলেটাকে দশ
টাকা দিয়েছিল। এখন তার মনে হচ্ছে
আরো কিছু টাকা দিতে পারলে ভাল
হতো। সুন্দর চোখের ছেলেটা যে এত
পাকাপোক্ত ভাবে তার মনে স্থান করে
নেবে সেটা ভাবিনি আবিদ। আরো কিছু
টাকা না দিতে পেরে প্রচণ্ড রকমের মন
খারাপ হচ্ছে । আজ আর অফিসে যেতে
ইচ্ছে করছেনা।কাজে মন বসবে না।তাই
মত পাল্টেছে।সিএনজি চালককে ভাড়া
দিয়ে সে নেমে গেল।মায়ের কাছে
গেলে কেমন হয়?আবিদের মা জাহানারা
বেগম গত দুইমাস ধরে হাসপাতালে ভর্তি
আছেন ।হাটতে পারছিলেন না তাই
হাসপাতালে রাখা হয়েছে।একজন নার্স
সব সময় তার পাশে থাকে।নার্সের নাম
সোমা।আবিদের মা নাম বদলে দিয়েছে।
প্রথম দিন হাসপাতালে গেয়েই নাম বদলে
দিয়েছে।জাহানারা বেগম বললেন,মা
তোমার নাম কি?
মেয়েটা বলল,সোমা।
জাহানারা বেগম বললেন,সোমা কোনো
নাম হলো! তুমি মুসলমানের না? মুসলমানের
মেয়ের নাম হবে মুসলমান ,মুসলমান।
তোমার নাম জান্নাতুল ফিরদাউস।জান্নাত
ুল ফিরদাউস কিসের নাম জানো?
বেহেস্তের নাম।এক নম্বর বেহেস্ত ।
কয়টা বেহেস্ত আছে জানো?
মেয়েটা বলল, আটটা না নয়টা খালা?
জাহানারা বেগম পড়লেন মহাবিপদে।মনে
করতে পারছেন না।এখন কি জবাব দেবেন।
স্বাভাবিক ভাবে আবিদকে বললেন,তুই
বলতো কয়টা?
আবিদ বলল,মনে নেই।
জাহানারা বেগম বললেন,তা কেনো মনে
থাকবে।গাদাগাদা গল্পের বই পড়ো
তাহলে মনে থাকবে।যাও আমার সামনে
থেকে ধুর হও।
আবিদ চলে গেল।জাহানারা বেগম
রেগে গেলে তুই থেকে তুমিতে আসে।
অধিকাংশ লোক আপনি,তুমি থেকে
তুইতোকারিতে আসে।আর উনি আসেন
উল্টো।আবিদের বাবার সাথে ঝগড়া হলে
তুমি থেকে আপনিতে যেতেন।আবিদের
বাবা মিচকে মিচকে হাসতো।
.
আবিদ মায়ের পাশে বসে আছে।
জাহানারা বেগম দুদিন ধরে কথা বলতে
পারছেন না।সোমা মেয়েটা
কেঁদেকেটে অস্থির।আবিদ লক্ষ্য করল
মেয়েটা তার মাকে খালা বলছেনা,মা
বলছে।আবিদ মায়ের কাছে গেল।মার মুখ
নাড়ছে,কিন্তু কথা বের হচ্ছে না।আবিদ
বলল,মা তুমি কি বলছো? কিছু বুঝতে
পারছিনা।
জাহানারা বেগম কাঁদছেন।নীরব কান্না।
শুধু চোখ থেকে পানি পরছে,শব্দ হচ্ছে না।
মহান আল্লাহ সবকিছু হয়তো নির্দিষ্ট
পরিমাণ দেন।সেই পরিমাণ অতিক্রম করতে
দেন না।জাহানারা বেগম সারাজীবন
অনেক কথা বলেছেন। হয়তো কথার
পরিমাণ শেষ হয়ে গিয়েছে।তাই
সৃষ্টিকর্তা তার কথা বলা ক্ষমতা কেড়ে
নিয়েছেন।আবিদের চোখে পানি টলমটল
করছে।সে চোখের পানি লোকানোর
চেষ্টা করলো।তাড়াতাড়ি উঠে
হাসপাতালের বারান্দায় গেলো।চোখ
মুছলো।তারপর আবার ঘরে ঢুকলো।হটাৎ
মনে হলো মা কথা বলছেন।বলছেন,আবিদ
তুই কাঁদছিস কেনো?সব মানুষ কি কিয়ামত
পর্যন্ত বেঁচে থাকবে? কিন্তু না।আবিদ
দেখলো মা চোখ বন্ধ করে আছেন।হয়তো
ঘুমিয়ে পড়েছেন।মৃত্যুর সময় মানুষ হটাৎ
করে ঘুমিয়ে পড়ে।আবার হটাৎ করে
জেগে ওঠে।এই ঘুমকেই সম্ভবত কালঘুম
বলে।হয়তো জাহানারা বেগমের মৃত্যুর
সময় হয়েছে।আবিদ কিছু সময় মায়ের পাশে
বসে থেকে উঠে দাঁড়ালো। মাকে
ডাকলো না।বড়বড় পা ফেলে সিঁড়ির
দিকে গেলো। সিঁড়িতে পা দিতেই মনে
হলো সোমা নামের মেয়েটা চিৎকার
করে কাঁদছে। সে ফিরে গেলো।কই
কেউতো কাঁদছে না।আপন মানুষের মৃত্যু
আগে থেকে বোঝা যায়।সৃষ্টিকর্তা এই
ক্ষমতা মানুষকে দিয়েছেন।আবিদ সিঁড়ি
দিয়ে নেমে গেল।মোবাইলে টাকা
নেই। টাকা ভরতে হবে মায়ের গ্রামের
বাড়িতে ফোন করতে হবে।সেখানে
মায়ের চাচাতো ভায়েরা,বোনেরা
আছেন।বাবার গ্রামের বাড়িতেও ফোন
করতে হবে।আবিদ শক্ত রাস্তার উপর দিয়ে
হাটছে।এই শহরের অধিকাংশ মানুষ শক্ত
রাস্তার মতো শক্ত হয়ে গেছে।তারা
অতি সহজে ভেঙে পড়েনা। আবিদ শক্ত
হতে চেষ্টা করছে।কিন্তু পারছেনা।
চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু পারছেনা।গলা যেন আটকে আসছে।
চোখ থেকে পানি পরছে।এই শহরে অনেক
মানুষ। সবাই ব্যস্ত। কেউ বলছে না যে,এই
আবিদ,কাঁদছিস কেনো? আমরা তো আছি।
কেউ বলছে না,কেউ না।
.
জাহানারা বেগম মৃত্যুর আগে ছেলের
হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে
গেছেন।কাগজে লেখা,
বাবা আবিদ ,পৃথিবীর অধিকাংশ লোক
সুনাম অর্জনে ব্যস্ত।পৃথিবীর সুনাম আসল
সুনাম না।সুনাম আশা করা ঠিক না।ভাল
কাজের ফল পাবে পরকালে।সেই ফল
পৃথিবী থেকে পাওয়ার আশা করো না।
আমাদের নবীজি সারাজীবন কষ্ট
করেছেন।তিনি যশ খ্যাতির ধার ধারেন
নি।বাবা,তোমাকে অনুরোধ করছি,তুমি
সোমা নামের মেয়েটাকে বিয়ে করো।
আমি তাতে শান্তি পাব।মেয়েটির
বাবামা নেই।মামার সংসারে থেকে
মানুষ হয়েছে। মেয়েটাকে বিয়ে করলে
হয়তো যশ খ্যাতির অধিকারী হতে
পারবেনা।তবে সুখে থাকতে পারবে।যশ
খ্যাতি যে তুচ্ছ ব্যাপার সেকথা
তোমাকে অনেকবার বলেছি।আশা করি
আমার শিক্ষা বিফলে যাবেনা।
.
জাহানারা বেগমের
যায়নি।আবিদ মেয়েটাকে বিয়ে
করেছে।তাদের একটা মেয়ে হয়েছে ।
নাম ফাতেমা।মুসলমান,মুসলমান নাম।
মেয়েটার বয়স পাঁচ বছর।মেয়েটা
জাহানারা বেগমের একটা বৈশিষ্ট্য
পেয়েছে।রেগে গেলে তুই থেকে তুমি
,তুমি থেকে আপনিতে যায়।মেয়েটা
আবিদকে বলছে,আপনাকে চলে যেতে
বলেছি না।যাচ্ছেন না কেনো। না
গেলে আমি আম্মুকে ডাকবো।যান এখান
থেকে,যান বলছি। জান্নাতুল ফিরদাউস
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে
কাঁদছে। হারিয়ে যাচ্ছে
অতীতে,হাসপাতালের সেই দিন
গুলোতে।
শিক্ষা বিফলে